সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে রাহনুমার।
দ্রুত নিঃশ্বাসের সাথে বুক উঠানামা করছে অস্বাভাবিকভাবে। তাকে দেখে লাগছে বাঘের তাড়া খেয়ে ছুটে পালানো কোন ত্রস্ত হরিণের মতো, বুঝি এখুনি এসে গেলো বাঘের নাগালে। ঘামে ভেজা মুখ ১০০ ওয়াটের বালবের আলোয় চকচক করছে। মনে হচ্ছে ছোট ছোট মুক্তোর দানা বিন্দু বিন্দু করে লাগানো আছে মুখের মাঝে।
একরামের ঘুম ভেঙ্গে গেছে। রাহনুমার পাশে ঘুম জড়ানো চোখ নিয়ে বসে আছে। গত চল্লিশ বছর ধরেই এমনটা হচ্ছে। যখন তখন রাহনুমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম থেকে উঠে ঘামে জবজবে শরীর আর দ্রুত নিঃশ্বাসে উঠানামা করা বুক নিয়ে সে বসে থাকে ভীত সন্ত্রস্ত অসহায় হরিণের মতো।
একরাম চোখ কচলে টেবিলের দিকে যায়। সে জানে রাহনুমা এখুনি পানি খেতে চাইবে। পানির জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে রাহনুমার দিকে এগিয়ে আসে।
রাহনুমা কোন দিকে না তাকিয়েই উদ্ভ্রান্তের মত বললো, পানি ! পানি খাবো !
একরাম পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়।
ঢক ঢক করে পানির গ্লাসটা খালি করে ফেলে রাহনুমা। কিছুটা পানি গড়িয়ে পড়ে তার বুক ভিজিয়ে নিচের দিকে নেমে যায়। এতক্ষনে কিছুটা পানি তার চোখ থেকেও গড়াতে শুরু করেছে।
আবার স্বপ্ন দেখেছ? একরাম নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করে।
একরাম অবশ্য জানে রাহনুমা আবার স্বপ্নটা দেখেছে। তবু পরিস্থিতিটাকে একটু হালকা করতেই প্রশ্নটা করা। রাহনুমাও জানে একরাম জেনেই প্রশ্নটা করেছে। তাই সেও আস্তে করে উত্তর দেয়, হুম।
- স্বপ্ন তো স্বপ্নই, তাই না?
- যখন দেখি তখন আর স্বপ্ন বলে মনে হয় না। মনে হয় সত্যিই আমি নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি, আর একটা খেয়া পারের ছোট ডিঙ্গি ডুবে যাচ্ছে, তার সাথে কেউ একজন ডুবে যাচ্ছে।
- ভয় পেয়েছ?
- হুম
- তুমি তো ডাক্তারের কাছেও যেতে চাওনা।
- ডাক্তারের কাছে কেনো যাবো? আমার তো কোন অসুখ হয়নি।
- অসুখ নাতো কি? কয়দিন পর পরই স্বপ্ন দেখো তুমি নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছো, আর আমি ডিঙ্গি করে নদী পাড় হতে গিয়ে ডুবে মরে যাচ্ছি। এটার কোন মানে আছে। নদীর কাছে তো দূরের কথা তোমাকে নিয়ে তো কোনদিন পুকুরের কাছেও যাইনি।
একরাম বালিশটাকে ঠিক করে নিয়ে আবার ঘুমাবার আয়োজন করে।
- আচ্ছা, আমাদের দেশের গড় আয়ু কত এখন? একরামের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে জানতে চায় রাহনুমা।
- কেন? হঠাৎ আয়ু জানতে চাইছো কেন?
- বলই না, কথার পিঠে কথা আমার একদম ভালো লাগে না।
- পুরুষদের ৬৮ আর মহিলাদের ৭০
- তাহলেতো আর বেশিদিন সময় নেই হাতে ৬১ হয়ে গেছে
- হুম, তা ঠিকই বলেছ। এত বছর যে বেচে আছি সেইতো অনেক। কত লোকজনতো জীবন শুরু হবার আগেই মরে যাচ্ছে। সে হিসেবেতো এখন বোনাস পিরিয়ড চলছে আমাদের।
- হুম, কত লোক তো জীবন শুরু হবার আগেই মরে যাচ্ছে। বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রাহনুমা। চল্লিশ বছরের পুরনো দীর্ঘশ্বাস। তার দু চোখ দিয়ে আবার অশ্রু গড়াতে শুরু করেছে। বাতি বন্ধ থাকায় একরাম দেখতে পাচ্ছে না।
কিছুক্ষনের মধ্যেই একরামের ভোস ভোস ঘুমের আওয়াজ পাওয়া যায়। রাহনুমা জেগে থাকে। সে আর ঘুমাবে না। ফিরে যাবে ৪০ বছর আগের দিনগুলোতে। যে দিনগুলি সে কোনদিনও ভুলবে না। যে দিনগুলো এতদিন পরেও তার কাছে ধরা দেয় স্বপ্নে এসে।
২)
রোজকার মতই সবাই সবার জীবন শুরু করেছে। রাস্তার ইলেক্ট্রিকের তারের উপর বসে কাকগুলো কা কা করেই যাচ্ছে। রাহনুমার বারান্দার হাসনা হেনা গাছ থেকে কড়া ঘ্রাণ আসছে। একরাম হয়তো এতক্ষনে তার অফিসে রোজকার কাজ শুরু করে দিয়েছে। গভর্নমেন্টের চাকুরী থেকে রিটায়ারমেন্টের পর কিছুদিন ঘরে শুয়ে বসে সময় কাটিয়েছে। পরে বেকার জীবন ভালো না লাগায় একটা প্রাইভেট ফার্মে কন্সালটেন্ট হিসেবে যোগ দিয়েছে। সময় ভালোই কাটছে। রাহনুমারও সময় কাটে। ছেলেপুলে নেই, একাকী জীবন। বহু বছর একটা স্কুলে শিক্ষকতা করেছে। স্কুলের চাকুরীটা নেয়ার পিছনে কারন ছিল সবসময় ছোট ছোট ছেলে মেয়ের মাঝে থাকা। এতে কাজও হয়েছিল কিছুটা। নিজের ছেলে মেয়ে না থাকার ব্যাপারটা ভুলেই গিয়েছিল সে।
আর যদি হুট করে কখনো শীতের বাতাসের মতো কোন ফুটো দিয়ে সে ব্যাথাটা তার হৃদয়ে ঢুকেই যেত, তখন সে আলমারি খুলে তার সন্তানকে বের করতো।
কফির পেয়ালা হাতে নিয়ে হাসনা হেনার গন্ধ আর কাকের কা কা ডাকের মাঝে এসকল ভাবনা মিলে একটা ঘোলাটে অবস্থা তৈরী হয় মনের মাঝে।
হুম, রাহনুমারও একটা সন্তান ছিলো। ছিলো কি আছে? ভ্রুন হয়ে আছে। পৃথিবীর আলো দেখতে পায়নি। রাহনুমার খুব ইচ্ছে সেই ভ্রুণটাকে পৃথিবীর আলো দেখায়।
চল্লিশ বছর ধরে সেই ভ্রুণ লালন করে যাচ্ছে রাহনুমা।
রাহনুমা ঘরে ভিতর আসে।
তার বুকশেলফ থেকে একটা পুরোনো ডায়েরী খুলে- তার সন্তান। চামড়ার কাভার দিয়ে বাধানো ডায়েরী। জীর্ণ শীর্ণ কাভার। জায়গায় জায়গায় ছিড়ে গেছে। চামড়ার ফুটো ভেদ করে ফোমের অংশ উকি ঝুকি মারছে। এই ডায়েরীর বয়স কত সে জানে না। তবে চল্লিশ বছর ধরে এটিকে সে সযতনে আগলে রেখেছে। ডায়েরীর পাতার ভিতর প্রথম পাতায় বড় করে লেখা ‘ পাণ্ডূলিপি’। তারপর একের পর এক পাতা উলটে যায় রাহনুমা। একটির পর একটি কবিতা পড়ে যায়। কত ধরনের কবিতা- সমাজ, দর্শন, প্রেম, প্রকৃতি কিছু বাদ নেই। পুরো পান্ডুলিপিতে তিহাত্তরটি কবিতা। গত ৪৪ বছর ধরে পড়তে পড়তে তার মুখস্ত হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে পাতা উল্টায় আর ডায়েরীর গায়ে হাত বুলিয়ে যায় রাহনুমা। আর ভাবে সময় বেশী নেই। গড় আয়ু যদি ৭০ বছর হয়, আর সময় বেশি নেই। সবাই তো ৭০ বছর বাচেও না, সত্যি সময় বেশি নেই। সেই সংক্ষিপ্ত সময়ও রুটিন মেনে তার মত করে চলে যাচ্ছে।
৩)
রাহনুমা তখন সবে কলেজে উঠেছে। আর তখুনি তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো। রাহনুমা খুব খুশি। পড়াশোনা তার ভালো লাগে না। বিয়েটা হয়ে গেলে পড়াশোনা সে বাদ দিয়ে দিবে। রাহনুমার মা-বাবা চেয়েছিলেন বিয়েটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাক। দেশের অবস্থা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। কখন কি হয়ে যায়, কেউ বলতে পারে না। মেয়েকে নিয়ে তাই খুব একটা ভরসা পাচ্ছিলেন না। এমন রুপবতী কিশোরী মেয়ে এ তল্লাটে নাই। তাই তাড়াহুড়া করেই রাহনুমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো।
মাঈনুল ভাইকে রাহনুমার দারুন পছন্দ। যদিও মাঈনুল ভাই সব সময় ধমক দিয়ে কথা বলে। তবুও তার ভালো লাগে। রাহনুমার মনে হয় বিয়ের পর সে এমন সব কাজ করবে যাতে মাঈনুল ভাইয়ের মেজাজ যখন তখন বিগড়ে যায়। মাঈনুল ভাই ধমকে যাবেন আর রাহনুমা হাসতে থাকবে। ধমক দিতে দিতে মাঈনুল ভাই ক্লান্ত হয়ে যাবে, কিন্তু হাসতে হাসতে সে কখনই ক্লান্ত হবে না।
মাঈনুল ভাইও তখন কলেজে পড়ে। তার কলেজ জীবন শেষ হবে হবে করছে। বয়স হবে ২০/২১ বছর। বড় বড় বাবরী চুল। তামাটে বর্ণ। খোচা খোচা দাড়ি। আর বিগড়ানো মেজাজ। এই বিগড়ানো মেজাজটাই রাহনুমার সবচেয়ে পছন্দ ছিলো।
কিন্তু মাঈনুলের বোধ হয় রাহনুমাকে পছন্দ হতো না। দেখলেই কেমন ধমকে ধমকে কথা বলতো। রাহনুমা আর মাঈনুলের বিয়ে ছোটবেলা থেকেই ঠিক করা। মাঈনুলের নানা ছোটবেলায় মাঈনুল আর রাহনুমার ভাব দেখে মাঈনুলের বাবাকে বলেছিলেন, আমিনুল, তোর ছেলের সাথে রাহনুমার বিয়ে দিব। আমি যদি মরেও যাই তুই কিন্তু আমার কথা রাখবি। রাহনুমার বাবারও বোনের ছেলের সাথে মেয়ের বিয়েতে কোন আপত্তি ছিলো না। বরং তিনিও এমনটাই চেয়েছিলেন। মেয়ে ঘরেই থাকুক, অন্য কোথাও না যাক। এই মেয়ে অন্য ঘরে চলে যাবে আর তিনি বসে বসে মেয়ের চিন্তায় না খেয়ে মরে যাবেন, এমন ভয় তার মনে সব সময়ই কাজ করতো।
মাঈনুল আস্তে আস্তে কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেল। কারো সাথে কোন কথা বলে না। একা একা কি জানি ভাবে সারাক্ষণ। কলেজে ইচ্ছে হলে যায়, ইচ্ছে হলে যায় না। কলেজ ছুটি হলে রাহনুমা মাঈনুলদের বাড়িতে যায়। মাঈনুল রাহনুমার সাথে কোন কথা বলে না। ঘরে ঢুকলে ধমক দিয়ে বের করে দেয়। রাহনুমার কেমন যেন লাগে। এই ধমক তো চিরচেনা ধমক নয়। মাঈনুলের মা-বাবার চোখে মুখেও দুশ্চিন্তা। ছেলে কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। তবে কি বিয়েতে মাঈনুলের মত নেই। সে কি অন্য কাউকে পছন্দ করে। মাঈনুলের বাবা স্ত্রীকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, কিগো মাঈনুলের মা, তোমার পোলার মতিগতি কিছু ঠাহর করতে পারো। তার কি এই বিয়েতে মত নাই?
আমি কেমনে কমু, মা হইয়া তো আমি পোলারে এই কথা জিগাইতে পারিনা, হের বিয়াতে মত আছে কি নাই। মাঈনুলের মা জবাব দেয়।
তাইলে কি বাপ হইয়া আমি গিয়া জিগামু পোলারে – মাঈনুলের বাপের পালটা বিরক্তি মেশানো প্রশ্ন।
মাঈনুলের মা মুখ ঝামটা দিয়ে চলে যায়। মাঈনুলের বাপ জোরে জোরে ছেলেকে শুনিয়ে বলে, আমি যা কমু সেইটাই ফাইনাল। এই সংসারে আমার মতের বিরুদ্ধে গিয়া কেউ থাকতে পারে নাই, পারবও না। মাঈনুল শুনে কিন্তু কিছু বলে না। বাপকে সে বড় ভয় পায়।
আকাশে মাঈনুল এর আগে এতো বড় চাঁদ দেখেনি। রাত খুব একটা হয়নি। কিন্তু সারাদিনের গতর খাটা ক্লান্তি শেষে যখন কিছুটা রাত নেমে আসে, এ গ্রামের মানুষগুলো গ্রামটাকে কবরের মত নিস্তব্দ করে দিয়ে ঘুম দেয়। কিংবা তারা ঘুমায় না। ভয়ে ভয়ে জেগে থাকে। রাতের নিস্তব্দতার পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে সে আস্তে করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো।
রাহনুমার চোখেও কোন ঘুম নেই। মাঈনুল ভাই তার সাথে এখন এমন করে কেনো? চিন্তায় তার ঘুম আসেনা। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে তার চেতনা ফিরে আসে। কে? ভয়ার্ত স্বরে সে জানতে চায়।
আমি, আমি মাঈনুল, চাপা স্বরে জবাব আসে। রাত্রির নিস্তব্দতা সে চাপা স্বরকেও পৌছে দেয় রাহনুমার মা-বাবার ঘরে। তারা হয়তো ঘুমিয়ে গেছেন, হয়তো বা জেগে আছেন।
রাহনুমা দরজা খুলে। চাঁদের আলোয় মাঈনুল ভাইয়ের তামাটে বর্ণ কেমন যেন ঔজ্জ্বল্য ছড়ায়, কিন্তু সেই উজ্জ্বল চেহারায় কিসের যেন একটা ফ্যাকাসে প্রলেপ ছড়ানো।
কেউ কিছু বলে না। মাঈনুল রাহনুমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আর রাহনুমা নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে।
আকাশে কেমন চাঁদ দেখসস রানু? চল খেয়া পাড়ের অইখানে যাই।
রাহনুমা তাকায় না। রাহনুমার চোখে পানি চলে আসে। চাদের আলোয় সেই অশ্রুবিন্দু মুক্তোর মত ঝরতে থাকে। মাথার ঘোমটাটা টেনে দিয়ে সে মন্ত্রমুগ্ধের মত মাঈনুলকে অনুসরন করে। কিছুটা পথ গিয়ে রাহনুমা তার হাতটা মাঈনুলের হাতে একটু একটু করে ছুয়ে দেয়। মাঈনুল শক্ত করে রাহনুমার হাতটা ধরে। রাহনুমা তার ঘোমটাটা ছেড়ে দেয়। নেশা লাগানো একটা চাঁদ তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। চাঁদের আলোয় দুই মানব-মানবী ...
চন্দ্রপুকুর নদী কলকলিয়ে বয়ে চলেছে। চাদের আলোয় চন্দ্রপুকুর নদীর রুপ যেন পূর্ণতা পেয়েছে। মনে হচ্ছে কেউ নদীর বুকে রুপার প্রলেপ ঢেলে দিয়েছে। নদীর পাড়ে অসংখ্য ছাতিম গাছ পাতা ঝরিয়ে দিচ্ছে বাতাসের তালে তালে। বাতাস, ছাতিম গাছ আর চন্দ্রপুকুর নদীর এই প্রণয়ের সাক্ষী হয়ে নদীর পাড়ে হাতে হাত রেখে চুপ করে বসে আছে মাঈনুল আর রাহনুমা।
- রানু?
- কি?
- আমি তোকে বিয়ে করতে পারবনা।
- রানু কোন উত্তর দেয় না
- আখিতাড়া গ্রামে মিলিটারী আসছে। অসংখ্য ঘরবাড়ি পুড়ায়া দিছে। নৃপেণ স্যাররেও মাইরা ফালাইছে।
- রানু কিছু বোঝে না। এটুকু বুঝে মাঈনুল ভাই অনেক খবর জানে। সারাদিন রেডিও নিয়া বসে থাকে, কোথায় কি হয় সব খোজ রাখে।
- রানু, অই যে দেখ ডিঙ্গি নাও দেখা যায়।
রানু মাঈনুলের আঙ্গুল বরাবর তাকায়। অদূরে একটা ছোট্ট ডিঙ্গি। দুই জন লোক বসে আছে।
চাদরের আড়াল থেকে মাঈনুল একটা ডায়েরী বের করে।
- রানু, এই ডায়েরীখানা তুই যত্ন কইরা রাখবি। আমি ফিরা আইসা তোর কাছ থেকে নিমু। যত্ন কইরা রাখবি, যেন হারায় না।
তারপর অনেকক্ষণ চন্দ্রপুকুর নদীর পাড়ে কোন শব্দ হয়নি। নদী তার কলকল শব্দ বন্ধ করে দিল। বাতাসের ও কোন শব্দ পাওয়া যায়নি। ছাতিম গাছগুলো কোন পাতা ঝরায়নি।
ডিঙ্গি নাও থেকে লোকজনের ঈশারা আসলো। মাঈনুল উঠে দাড়ালো। রাহনুমা সাথে সাথে গেলো, শক্ত করে মাঈনুলের হাতটা ধরে রইলো।
- বাড়ির কাউরে কিছু বলি নাই। তালিব জানে খালি। তুই সবাইরে বুঝায়া বলিস।
রানু মাথা নাড়লো। তার চোখ দিয়ে আরেকটা চন্দ্রপুকুর নদী নেমে গেছে তা মাঈনুল দেখতে পায়নি।
- ফিরে আসলে আমাদের বিয়ে হবে রানু। এখন কি বিয়ে করার সময় বল? যখন ফিরা আসবো তখন এই দিন থাকবো না। বিয়ের দিন রাতটা আমরা এই চন্দ্রপুকুর নদীর এই ছাতিম গাছের নিচে এই জায়গাটাতে কাটায়া দিমু? ঠিক আছে না?
- হুম, রাহনুমা এর বেশি কিছু বলতে পারলো না।
মাঈনুল ধীরে ধীরে চন্দ্রপুকুর নদীতে নেমে গেলো। যতক্ষন ডিঙ্গি নাও দৃষ্টির সীমানার মধ্যে ছিল রাহনুমা তাকিয়ে থাকল। অতঃপর নাওটা যখন আর দেখা গেলোনা, তখন তালিব কোথা থেকে এসে বললো, ভাবী চলেন, বাড়িত যাই। রাহনুমা, ডায়েরীটা শক্ত করে বুকে জড়িয়ে চাঁদের আলোয় এক বুক অন্ধকার নিয়ে হেটে চললো। রাহনুমার চন্দ্রপুকুর নদীতে জোয়ার এসেছে।
৪)
আরো একবার মাঝরাতে ঘর্মাক্ত শরীর আর ঘুম জড়ানো চোখ নিয়ে বসে আছে রাহনুমা। দ্রুত নিঃশ্বাসের সাথে বুক উঠানামা করছে অস্বাভাবিকভাবে। একরাম পানির গ্লাস হাতে নিয়ে বসে আছে। গ্লাসটা খালি।
- স্বপ্নটা আবার দেখেছি, নিচের দিকে তাকিয়েই রাহনুমা বললো।
- হুম। দেখলে আমি খেয়া পাড় হতে গিয়ে ডুবে মরে যাচ্ছি।
- আমি সারা জীবন তোমার কাছে একটা মিথ্যে বলে এসেছি।
- মিথ্যে?
- হুম, স্বপ্নে আমি আসলে তোমাকে দেখিনা। এতদিন মিথ্যে বলে এসেছি। স্বপ্নে আমি আসলে মাঈনুল ভাইকে দেখি। মাঈনুল ভাই ফিরে আসেননি। সবাই বলেছিল মাঈনুল ভাই খুব সাহসের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন মিলিটারির হাতে ধরা পড়ার আগে। তারপরের খবর আর কেউ কিছু বলতে পারেনা।
সে রাতে রাহনুমা অনেক কাঁদলো। যে কান্নাটা ৪৪ বছর আগে চন্দ্রপুকুর নদীর পাড়ে তার মাঈনুল ভাইকে জড়িয়ে ধরে সে কাঁদতে চেয়েছিল সেটা সে মিরপুরের দুই রুমের এই ফ্লাটটাতে মাঝরাতে একরামকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো।
৫)
অনেকদিন হয়ে গেলো, রাহনুমা এখন আর মাঝরাতের স্বপ্নটা দেখছেনা। রাতে তার খুব ভালো ঘুম হয়। একরামের ডায়াবেটিস আছে। রাতে মাঝে মাঝে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। অনেক সময় ভোর রাতের দিকে ঘুম ভেঙ্গে গেলে সে আর ঘুমায় না। আলমারি থেকে পুরোনো ডায়েরীটা বের করে পড়ে। সকাল হলে অফিস চলে যায়। রাহনুমা বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে কাকের ডাক শুনে। কাকের ডাক তার কাছে খুব একটা খারাপ লাগে না। হাসনা হেনা ফুল গুলো তাদের মত করে সুবাস ছড়িয়ে যায়।
অতঃপর একদিন একটা লোক আসলো রাহনুমাদের বাসায়। অফিস শেষে একরাম নিয়ে এসেছে। রাহনুমা লোকটাকে চেনে। ইনি একজন নামকরা প্রকাশক। বিদায় বেলায় প্রকাশক রাহনুমার পান্ডুলিপিটা নিয়ে যান। একরাম রাহনুমার কাধে হাত রেখে বলে, আগামী বইমেলায় পাণ্ডুলিপিটা বই আকারে বের করবো বলে ঠিক করেছি। প্রকাশক রাজী হয়েছেন। আমাদের তো আর বেশিদিন সময় নাই। তোমার ৭০ আর আমার ৬৮। বেশিদিন তো আর আমরা পান্ডুলিপিটাকে আগলে রাখতে পারবো না। বাকী যে কয়দিন সময় আছে হাতে চল দুজনে মিলে খুজে দেখি মাঈনুল সাহেবের শেষ ঠিকানাটা খুজে বের করতে পারি কিনা- কবর, বধ্যভূমি, যাই হোক। আর একটা কথা, নদীর পাড়ের সেই ছাতিম গাছটার নিচেও একদিন আমরা বসবো, যখন আকাশে ভরা পূর্নিমা থাকবে। রাহনুমা কিছু বললো না। তার চোখে ভেসে উঠলো, রুপালি নদী, জোছনা আর ছাতিম গাছের পাতা ঝরানোর শব্দ।